Friday, 9 December 2016

অপরিপূর্ণ ভালোলাগা

ছোট্ট একটা জেলা শহর তার মাঝে ছোট্ট একটা হোস্টেল,আর তারও মাঝে ছোট্ট একটা রুমে আমি আর আমার একজন বড় ভাই রুমমেট।

আমি সবে মাত্র (এইচ এস সি) সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছি।

কনকনে শীতের সকাল, সূর্যি মামার এখনো দেখা মেলেনি আর মিললেও ঘন কুয়াশায় তা বোঝার উপায় নেই।

হঠাৎ ভাঙ্গাচোরা ফোনটা বেজে উঠলো, এত্ত সকালে আবার কে?? আম্মু আব্বু তো এত সকালে ফোন দেওয়ার কথা না!
ফোন তুলে দেখি অপরিচিত নাম্বার, মহা বিরক্তি নিয়ে হ্যালো বলতেই.........

- সাফাত ভাইয়া? (ছদ্মনাম)
-হুম
-ভাইয়া আমি সামিয়া (ছদ্মনাম)
কাওসার স্যার আপনার নাম্বার টা দিছেন আর বলছেন আপনার কাছে নাকি "তাপগতি বিদ্যা" অধ্যায়ের অংক গুলা করা আছে?
আর সে গুলা নেওয়ার জন্য আপনাকে ফোন দিলাম।
মেয়েটি টানা বলছেই.........।।


এই সাত সকালে হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে পড়াশুনার কথা শুনে মাথা হ্যাং হয়ে গেছে মনে হচ্ছিলো।

ওহ হ্যাঁ...... কাওসার স্যার আমাদের পদার্থ বিজ্ঞানের টিচার। খুব বেশী ভালো ছাত্র না হলেও কেন জানি স্যার অন্য সবার থেকে আমাকে একটু বেশীই ভালোবাসতেন। কোন টপিক না বুঝলে একাই স্যারের বাসায় চলে যেতাম সেটা সকাল বা বিকেল, মাঝে মাঝে স্যারের বাসায় খাওয়া দাওয়াও হত।


চেতনা ফিরে পেয়ে বললাম...... 
-হুম আমার কাছে আছে কিন্তু খাতা টা যে কোথায় আছে খুজে দেখতে হবে, সেই ফাস্ট ইয়ারে পড়েছিলাম!!
-প্লিজ ভাইয়া একটু দেখেন না!! স্যারের দেওয়া সিট  দেখে কিছুই বুঝতেছিনা তাই স্যার আপনার কথা বলল যে আপনার খাতায় নাকি অনেক সহজ ভাবে করে দেওয়া আছে।
-হুম দেখতেছি
-ওকে ভাইয়া।

ফোন রেখে কি যেন ভাবতে ভাবতে আবার ঘুম! কিছুক্ষণ পর আবার ফোন!

-ভাইয়া পাইছেন?
-উম খুজতেছি! (মহা বিরক্তি নিয়ে)
-প্লিজ ভাইয়া দেখেন না একটু, আমি কলেজের সামনে দারিয়ে আছি আপনার খাতার জন্য।
-এখন??
-জি

এখন একটু বেশী বেশী হয়ে যাচ্ছে।এত  সকালে ঘুমই ভাঙ্গে না আবার কলেজ?? (মনেমনে)

-ওকে আমি খুজতেছি আর পাইলে আপনাকে ফোন দিচ্ছি।
-জি ভাইয়া।
  
একবার মনে হল ফোনটা বন্ধ করে আবার ঘুমাই কিন্তু কাওসার স্যারের কথা মনে হয়ে বাধ্য হয়েই বেড থেকে উঠে ফ্রেশ হলাম।

টেবিলে উপরের দিকেই খাতাটা ছিল কারন কিছু দিন আগেই ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষা গেছে। সকালে হোস্টেলের খাবার আমার কখনোই ভালো লাগতো না তাই বাইরেই খেতাম আজও না খেয়েই বের হয়ে সামিয়াকে ফোন দিলাম......

-কই আপনি?
-ভাইয়া আমি তো “জলযোগ এ আছি ”(শহরের বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট), আপনি কি কলেজের সামনে?
-না, মাত্র হোস্টেল থেকে বের হলাম,
-ওকে ভাইয়া আপনি কলেজের সামনে আসেন আমিও আসতেছি,
-উম নাহ আপনি ওখানেই থাকেন আমি আসছি।
-জি ভাইয়া।

ভালোই হল খাতা টাও দেওয়া হবে আর সকালের নাস্তা টাও সারা যাবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রিকশা নিয়ে আমি জলযোগের সামনে হাজির, ভাড়া মিটিয়ে ভীতরে ঢুকতেই হাবিব (হোটেল বয়) বলল কি মামা আজ এত সকাল সকাল?

-ক্যান আমি কি সকালে আসি না?
-নাহ তা না কিন্তু আপনার তো আবার সকাল হয় ১২ টায়।

হরে ভাই তুই বুঝলি কিন্তু মেয়েটা বুঝল না!! (মনেমনে)

সামিয়াকে ফোন দিতেই বলল
-ভাইয়া আপনি কি আসছেন?
-হুম আমি তো ভীতরে কিন্তু আপনি কই?
-আমি দোতলার ৬ নাম্বার টেবিলে।
-হুম ওয়েট।

উপরে উঠতেই দেখলাম ৬ নাম্বার টেবিল থেকে একটা মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাত তুলল, আমিও হাত তুলে সায় দিলাম
 কাছে যেতেই

-আপনি সাফাত??
-হুম ক্যান?? কোন প্রবলেম?
-না সেটা হবে কেন?আমি আপনাকে চিনি কিন্তু নাম জানতাম না।
-ওহ আচ্ছা, কিভাবে চেনেন?
-ভাইয়া আমি কিন্তু (এইস এস সি) ফাস্ট ইয়ার মানে আপনার থেকে ১ বছরের ছোট।
-ওহ হ্যাঁ বলো।

এর মধ্যেই হাবিব নাস্তা নিয়ে হাজির, ওরে বললাম আরেকটা নাস্তা দিতে কিন্তু সামিয়া বলল সে খাওয়া শেষ করে আমার জন্য অপেক্ষা করছে তাই সে খাবে না।

আমি খাওয়া শুরু করলাম আর মেয়েটা নিজের মনে কথা শুরু করলো,

-আমাদের ব্যাচে একটা মেয়ে আছে যে আপনাকে পছন্দ করে কিন্তু ভয়ে নাকি বলতে পারে না।
-তাই নাকি? নাম কি?
-উহু সেটা তো বলা যাবে না।
-ওকে কিন্তু আমাকে চেনে কিভাবে? বা দেখলো কিভাবে?
-কাওসার স্যারের কাছে আমাদের পড়া থাকে ৪টায় আর আপনাদের ৪টায় পড়া শেষ হয় আর বের হওয়ার সময় আপনাকে দেখেছে ও। 
-ওহ আচ্ছা বাদ দাও, তোমার কোন চ্যাপ্টার টা যেন লাগবে? (একটু লজ্জা পেয়ে টপিক চেঞ্জ করলাম)
- তাপগতি বিদ্যা।
-শুধু এটাই?
-নাহ ভাইয়া “ভেক্টর” চ্যাপ্টারেও একটু প্রবলেম আছে, আপনি কি একটু রিভিউ দিয়ে দিবেন?
-এখন?
-হুম কেন কোন প্রবলেম?
-উম তা না, আচ্ছা নাস্তা টা শেষ করি?
-ওকে।

খাওয়া শেষে প্রায় ৩৫-৪০ মিনিটের মধ্যে ২টা অধ্যায়ের অংক গুলা মোটামুটি রিভিউ দিয়ে দিলাম।
শেষে সে বলল......
-বুঝছি ভাইয়া কেন কাওসার স্যার আপনাকে এত চয়েজ করে।
-আরে না এমন কিছু না, এই সাবজেক্টটা একটু ভালো লাগে তাই এটাই বেশী পড়ি আর সে জন্য একটু আধটু পারি আর কি!
-হুম বুঝলাম।

সব শেষে সে বলল আচ্ছা চলেন উঠি, আমার আবার হোস্টেলে যেতে হবে,
-তুমি কি হোস্টেলে থাকো?
-জি ভাইয়া, “রাবেয়া” ছাত্রি হোস্টেলে।
-ওহ আচ্ছা।


নাস্তার বিল দিয়ে দুজনই নিচে নামলাম, নিচে নেমে ওকে একটা রিকশায় তুলে দিলাম আর সে বলল অংক গুলা নোট করে ২-৩ দিনের মধ্যে আমার খাতা ব্যাক দিবে।
আমি ও সায় দিয়ে আরেকটা রিকশা নিয়ে হোস্টেলের দিকে রওনা হলাম......।।

রিকশায় বসে কাওসার স্যার কে মনে মনে একটা ধন্যবাদ দিলাম, স্যার নাম্বার না দিলে আজ সামিয়ার সাথে পরিচয় হত না। 

মেয়েটার মধ্যে কি যেন একটা আছে যা আমি অন্য মেয়েদের মধ্যে দেখিনি।
হরিনের মতো চোখ,জিরাফের মতো লম্বা, মায়াবি মুখ এগুলো হয়তোবা হবে না কিন্তু আশ্চর্য রকমের একটা সৌন্দর্যতা আছে,
আর সব থেকে বেশী আকর্ষণীও ওর ফ্রাঙ্কলি কথা বলার ধরন।

সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল কিন্তু ওর কোন ফ্রেন্ড আমারে মনে মনে পছন্দ করে ঝামেলাটা বাধাল, যাইহোক মনে মনে করে প্রকাশে তো আর বলে নি!!

এমন অনেক কিছু ভাবতে ভাবতেই হোস্টেলে চলে আসলাম কিন্তু সামিয়া যেন মনের মধ্যে যেকে বসেছে! কোন ভাবেই ওর কথা মাথা থেকে ঝারতে পারছি না!!


সত্যি কথা বলতে এক প্রকার ভালোলাগা কাজ করতে ছিল, জানি না এটা “লাভ এট ফার্স্ট সাইট” কিনা তবে সত্যিই মনের মধ্যে অন্য রকমের ভাললাগা কাজ করছিলো। মনে মনে ভাবলাম আমার খাতা যেহুতু ওর কাছে আছে তাই সেটাকে উদ্দেশ্য করে ফোন দেওয়া যাবে বা ও নিজেই ফোন দিবে।


এভাবে ভাবতে ভাবতে ১দিন চলে গেলো আর পরের দিন ভাবলাম ফোন দিবো কিন্তু কি মনে করবে এই ভেবে আর ফোন দেওয়া হয়নি।

এভাবে ৩দিন ফোন না দিয়ে ভাবলাম ওর নোট করা শেষ হলে নিজেই ফোন দিবে কিন্তু চতুর্থ দিনেও ওর ফোন না পেয়ে সন্ধায় আমিই ফোন দিলাম, কিন্তু ফোন বার বার বন্ধ দেখাচ্ছিল।
এভাবেই ২দিন ফোন দিলাম কিন্তু ২দিনি ফোন বন্ধ, তখন আর আমার মধ্যে খাতার কথা নেই শুধু ভাবছিলাম ওর ফোন বন্ধ কেন?


পরের দিন কাওসার স্যারকে সামিয়া এবং খাতার কথা খুলে বললাম, স্যার বলল ওই মেয়ে তো আমার কাছে গত ২দিন পরতে আসেনি, হয়তোবা কোন প্রবলেম তাই আসছে না।

আমিও আর স্যারের সাথে কথা না বারিয়ে টপিক চেঞ্জ করলাম আর ভাবতেছিলাম যে ফোন বন্ধ থাক কিন্তু কলেজে বা প্রাইভেটে তো সে আসবেই।


এভাবে প্রায় ১৭-১৮ দিন পার হল কিন্তু সামিয়ার ফোন ও বন্ধ আবার স্যারের কাছে পরতেও আসে না। আর এ দিকে তো আমি চিন্তায় শেষ!

শেষ পর্যন্ত কোন উপায় না পেয়ে সেই ৪টার ব্যাচের মেয়েদের সামিয়ার কথা জিগ্যেস করলাম।
ওরাও নাকি সামিয়ার কোন খবর জানে না আর গত কিছুদিন ধরে দেখাও হয় না।

আমার মনে তখন একটাই প্রশ্ন মেয়েটা কি হাওয়া হয়ে গেলো?

সত্যি কথা বলতে খাতার জন্য একটা বারও ফোন দেইনি বা খবর নেই নি, কিন্তু কি জন্য খবর নিছি সেটাও বলতে পারব না।  তবে এটুকও বলতে পারি কেন জানি ওকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিলো.........হয়তোবা ভাললাগা বালবাসা বা অন্য কোন কারনে!!


যখন কলেজ পাশ করে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে স্যারের সাথে দেখা করতে গেছি তখনও স্যারকে জিগ্যেস করেছিলাম সামিয়ার কথা কিন্তু স্যারও নাকি তারপর থেকে ওকে আর কলেজে বা প্রাইভেটে দেখেনি এমনকি ওর বান্ধবীদের থেকেও কোন খবর মেলে নি!!

গত ৩বছরে ভার্সিটি বা বাইরে অনেক মেয়ে দেখেছি কিন্তু সামিয়ার মতো কাওকে পাইনি যাকে প্রথম দেখাতেই ভালো লাগে।

কখনো ওকে ফিরে পেলে একটা চর দিয়ে জিগ্যেস করতাম খাতাটা নিয়ে কেন হারিয়ে গেছিলা? তোমার জন্য আমার আবার নতুন করে নোট করতে হইছে আর সাথে অনেক কষ্ট!!

কোথায় যেন পরেছিলাম  “দ্বিতিও দেখায় প্রণয় নিশ্চিত বলে 

প্রথম দেখাই শেষ দেখা রয়ে যায়”  

আজও মনে মনে সামিয়াকে খুজি কিন্তু নোট খাতার জন্য না...............ভালোলাগা টাকে ভালবাসায় রূপান্তরিত করার জন্য।।

No comments:

Post a Comment

Thanks for your comment