Wednesday 10 January 2018

একজন ওমর ফারুক

ময়টা ঠিক মনে নেই, তবে ২০০২-৩ এর দিকে হবে। বডিং এ নতুন একজন পিচ্ছি 
এসেছে, মোটামুটি শান্তশিষ্ট বোঝা যায়, শ্যাম বর্ণ চেহারার মদ্ধে একটা মায়াবি ভাব 
আছে।
এ আর নতুন কি? কত ছেলেই তো আসে এখানে, কেও এই পরিবেশে মানিয়ে নেয়  
আর কেওবা আবার পড়িবার পরিজন ছাড়া কিছু দিন কান্নাকাটি করে ঘরে ফিরে যায়।
এতক্ষণ যেই ছেলেটার কথা বলছি নাম তার ওমর ফারুক

আর জায়গাটা পাবনা জেলার প্রান কেন্দ্রে অবস্থিত “পাবনা ইসলামিয়া ইয়াতিমখানা” 
হ্যাঁ ইয়াতিমখানা!! ঠিকই পড়েছেন।

অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ছেলেটা তার ব্যবহারে চলাফেরা আর আচার আচারন দিয়ে 
সবার মন জয় করে নিল, মানে সবার মধ্যমণি আরকি! ছেলেটা ছাত্র হিসেবেও খারাপ 
না। আর ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়ে সেটার প্রমাণ ও রাখলো

বছর যায় বছর আসে কিন্তু ছেলেটার মধ্যে খুব বেশী পরিবর্তন নেই! তবে হ্যাঁ দিন দিন 
তার ফ্যান ফলোয়ার যেন বৃদ্ধি পাচ্ছিলো।

আর বারবেই বা না কেন? কোথায় নেই সে?
দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ,সবার সাথে হাসি মুখে কথা, ছোটদের স্নেহ আর বড়দের 
সন্মান, সময়মত পড়ালেখা, বিকেলে খেলাধুলা, এমনকি মাদরাসার সকল প্রকার 
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও সে! হোক সেটা নাটক কবিতা আবৃতি বা কোরআন তেলয়াত। 
তার গজলের সুর এখনো আমার কানে ভাসছে।

কারো কোন বিন্দু মাত্র অভিযোগ ছিল না তার নামে, হোক সেটা শিক্ষক, বন্ধু বা 
মাদরাসার কর্মচারী

এভাবেই এস এস সি (দাখিল) পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ ফলাফল অর্জন 
করে কাদিরাবাদ ক্যান্টনমেন্ট স্যাপার কলেজ, নাটোরএ ভর্তি হয় আর এখানেও সে তার অধ্যবসায় বজায় রেখে (এইচ এস সি) তেও সর্বোচ্চ ফলাফল অর্জন করে

এইচ এস সি পাশ করে সে যখন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের “Criminology and Police Science” ( পুলিশ এবং অপরাধ বিজ্ঞানবিভাগে ভর্তি হয়

আর তার স্বপ্ন যেন আকাশের মত বড় হতে থাকলো একদিন মস্ত বড় সৎ পুলিশ অফিসার হয়ে সমাজের অপরাধীদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিবে

এতদিন নিজের পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় পরিবারের খেয়াল রাখা হত না কিন্তু 
এখনতো কিছু করা যায়।
বাসায় ছোট বোন, ছোট ভাই আর বড় বোনের পিচ্চি গুলো এখন যে ভাইয়া আর 
মামার কাছে আবদার করা শিখে গেছে আর সেও টিউশনি করিয়ে নিজের খরচ আর 
পরিবারের ছোট ছোট আবদার গুলো রাখতে পারে।
আলহামদুলিল্লাহ্‌ জীবনটা এয়াতিম খানায় কাটলেও এখন তো স্বপ্ন দেখাই 
যায়...............।।


মাঝে মাঝে পিচ্চি বোনটাকে অনেক বেশী দেখতে ইচ্ছে হয় আর বাড়িতেও বেশী 
যাওয়ার সময় হয় না, তাই অনেক কিছু ভেবে মনে হল বোনটাকে নিজের কাছে 
আনলে ক্যামন হয়? সবসময় চোখের সামনে থাকবে আর নিজের হাতে পড়াশোনাও 
করানো যাবে।
যেই ভাবা সেই কাজ......পিচ্চি বোনটা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই ভাল একটা স্কুলে 
পরে, ক্লাস নাইনে

দিন শেষে রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তিটা মনে পরে যায় তোমার প্রজাপতির পাখা আমার আকাশ-চাওয়া মুগ্ধ চোখের রঙিন স্বপন মাখা । তোমার চাঁদের আলোয় মিলায় আমার দুঃখ-সুখের সকল অবসান”।
ওমর ফারুক এখন বলতেই পারে, অনেক কষ্টের পর সুখের সূর্য এখন আমার আকাশে………স্বপ্ন গুলো এখন আকাশ ছাড়িয়ে যাওয়ার পালা।।


নভেম্বারের ১২ তারিখ সকাল
প্রতিদিনের মত আজো ঝাপসা চোখে দু পায়ে ভর দিয়ে কধের উপর পাঁথরের মত 
বোঝা নিয়ে ছাত্রের বাসার দিকে ওমর ফারুক।
এ বোঝা যে চোখে দেখা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়! আর এ অনুভবের ক্ষমতা 
সবার নাই।

এ যেন এক রবোটিক জীবন! প্রোগ্রামিঙের লুপের মত ঘুরছে! সারাদিন ক্লাস আর 
পড়াশুনা ছাড়া সবসময় টিউশনি করিয়ে দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ কিন্তু ওমর ফারুকের 
বিশ্বাস ছিলো এই লুপ একদিন ব্রেক হবেই আর সেটা দারিদ্র্যতার সাথে যুদ্ধ করেই।

সকাল নয়টার আগেই ওমর ফারুক তার ছাত্রের বাসায় হাজির, যথারীতি পরানো শুরু 
হল, কিন্তু কিছু সময় পর হঠাৎ- সে সেন্স লেস হয়ে মেঝেতে পরে যায়। প্রায় সাথে 
সাথেই ছাত্রের গার্জিয়ানরা হাসপাতালে নিয়ে যায় তাকে

টাঙ্গাইল হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার কি সব ভারি ভারি কথা বলতে লাগলেন
রোগীর ব্রেইন স্টক হয়েছে, এটা ওটা নিয়ে নানান কথাকিন্তু তার মাঝে এই টুকো বোঝা গেল যে ওমর ফারুক আর পৃথিবীতে নেই...!!! 

কিছুক্ষণ পর ডাক্তার ফর্মালিটি মেইনটেইন করে যানালেন রোগী হাসপাতালে আনার 
পথেই মারা গেছেন আর তার কারন ব্রেইন স্ট্রোক!!!

এটা কিভাবে সম্ভব???
যে ছেলেটা রাতেও রুমমেটদের সাথে আড্ডা দিল আর সে কিনা………!!!
যে দারিদ্র্যতার সাথে সারা জীবন যুদ্ধ করে মাত্রই আশার আলো দেখছিল আর তার 
জীবনের লুপ কিনা যুদ্ধতেই থেমে গেল???

আকাশ সমান স্বপ্ন গুলো এখনো তরতাজা কিন্তু স্বপ্ন সারথির নিথর দেহটি পরে আছে হাসপাতালের বেডে

বিখ্যাত লেখক/ কবি ‘জর্জ মুর’ বলেছিলেন  “Reality can destroy the dream, why Shouldn’t the dream destroy the reality?”

সত্যিই বাস্তবতার কাছে আকাশ সমান স্বপ্নও ফিকে হয়ে যায়।

রাত ১০ টা পার হতে চলল কিন্তু একটা ছোট্ট গ্রামের মানুষের চোখে ঘুম নেই কারন টাঙ্গাইল থেকে তাদের সবার আদরের ওমর ফারুক আসছে
গ্রামের মানুষের সাথে হাজির হয়েছে কিছু হতভাগা বন্ধু যারা সবাই তাদের প্রান প্রিও বন্ধুর জন্য অপেক্ষমাণ………।।

এখন কে ছোট বোনটাকে হাতে ধরে পড়াবে? আর তার খরচি বা বহন করবে কে?
পরিবারে ছোট ছোট আবদার গুলো কে মিটাবে?
কে পুলিশ হয়ে সমাজ পরিবর্তনের আশা দেখবে?
আর কেই-বা এ যুদ্ধ ক্ষেত্রের হাল ধরবে?
এত এত প্রশ্নের উত্তর যার কাছে সে যে কোন কথাই বলছে না!!

সপ্ন দেখতেই সেটা নিভে যায়, সাথে নিভে যায় একটা পড়িবারের আশা, শূন্য হয়ে যায় মায়ের কোল, হারিয়ে যায় পিচ্চি বোনটার ভাই আর বন্ধু মহলের আইকনিক ওমর ফারুক………………।।

সবশেষে টি এইচ হাকসলির’ একটা কথা মনে পরে যায় “জীবনের মহৎ পরিনতি অভিজ্ঞতায় নয় – কর্মে”
হ্যাঁ ওমর ফারুক হয়তোবা আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তার প্রতিটা কর্ম আমাদের স্মরণ করে দেয় একজন বন্ধু হারানোর বেদনা.........।।