Wednesday 30 November 2016

রিকশাওয়ালা মামা

কটা মানুষের যদি স্বপ্ন না থাকে তাহলে সে বেচে থাকে কি আশায়,কি নেশায়?
একটা মানুষ প্রতিদিন স্বপ্ন দেখবে আর সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার আশায় তার পিছু ছুটবে এটাই তো স্বাভাবিক তাই না?

আচ্ছা একবার ভাবুনতো যে আপনার কোন স্বপ্ন নেই তাহলে আপনি কেন বেচে আছেন আর ঘুম থেকে ওঠারই বা কি দরকার?

পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষেরই স্বপ্ন আছে সে হতে পারে নেতা, ব্যবসায়ী, চাকুরিজীবি, দিনমজুর,কিংবা ছাত্র। কিন্তু সবার স্বপ্নই কি সমান? 
না সবার স্বপ্নই সমান হয় না।

কারো স্বপ্ন অনেক অনেক অনেক বড় আবার কারো স্বপ্ন অতি ছোট কিন্তু কেন? 
স্বপ্ন দেখতে তো পকেটের টাকা যাচ্ছে না তাহলে সবার স্বপ্ন সমান হয় না কেন?


ধরুন মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন ছাত্র, তার স্বপ্ন সেও একদিন তার নিজের সাইকেলে করে স্কুলে যাবে কারন সে প্রতিদিন পায়ে হেটে স্কুলে যায়। আবার এমনি একটা ছাত্রের ইচ্ছে বাইসাইকেল তো অনেকদিন হল এবার একটা মোটর বাইক কিনতে হবে। 
আবার একজন বড় ব্যবসায়ীর স্বপ্ন এই টয়োটাতে আর কত দিন সামনে বছর একটা মার্সিডিজ হলে ভালো হয়। এমনি ভাবে স্বপ্ন গুলাও সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী ডিপেন্ড করে।

কিন্তু ভাবুনতো একটা মধ্যবয়স্ক অতি সাধারণ রিকশাওয়ালার কি স্বপ্ন থাকতে পারে??
এই মাসটা রিকশা চালায়ে একটা মোটর বাইক বা প্রাইভেট কার কিনবো? 
নাকি মাটির বাড়িটাকে দালান বানাবো! কোনটা??

পার্সোনালি আমার পছন্দের যানবাহনের মধ্যে রিকশা অন্যতম আর রিকশায় উঠে রিকশাওয়ালা মামাদের সাথে গল্প করতে আমি বরাবরই পটু, আর সে সুবাদেই ঢাকার রিকশাওয়ালা মামাদের সম্পর্কে কিছু ধারণা আমার হয়েছে। যেমন তারা ভাড়া রিকশা চালালে ফুল বেলা বা হাফ বেলা কত টাকা দিতে হয় মালিক কে, আবার তাদের থাকা খাওয়া সহ প্রতিদিন কেমন খরচ হয়, সারাদিন কেমন ইনকাম হয়, আরও অনেক কিছুই।


আবার অনেক ধান্দাবাজ রিকশাওয়ালাও দেখেছি যাদের বেশী ভাগই বলে তাদের মেয়ের বিয়ে বা ছেলে-মেয়ের স্কুলে ভর্তির টাকা নাই, এমন অনেক কথা বলেই সাধারণ যাত্রীদের থেকে সিম্পেথি পাওয়ার চেষ্টা করে। 


এমনি ভাবে একবার ভার্সিটি থেকে বাসায় যাওয়ার জন্য ২১-২২ বছরের একটা ছেলের রিকশায় চেপে বসলাম। যথারীতি গল্প শুরু করলাম, তার বাসা ছিল দিনাজপুরে আর নামটা ঠিক মনে নাই। বললাম মামা ঢাকায় কতদিন রিকশা চালাও?
-সে বলল মামা আমি আসলে রিকশা চালাই না, দিনাজপুরের একটা বেসরকারি পলিটেকনিকে পড়ি আর তার টাকা যোগাড়ের জন্য কিছু দিন হল ঢাকায় রিকশা চালাচ্ছি!!!  

তার কথাটা শুনে নিজের কাছেই নিজেকে ছোট মনে হচ্ছিলো কারন আমার বয়সী একটা ছেলে রিকশা চালিয়ে নিজের পড়াশুনার খরচ চালাচ্ছে আর আমি বাবার টাকা ছাড়া এখনো অন্ধ...।।  
যাইহোক তাকে কিছু প্রশংসা বাক্য শুনিয়ে জিজ্ঞেস করলাম মামা কোন সাবজেক্টে পড়েন আর খরচ কেমন?
-তার উত্তর ছিল মামা ইংরেজি সাবজেক্টে পড়ি আর খরচ ভালোই যায়!!! 

তার উত্তর শুনে আমি স্থির হয়ে গেলাম......... পলিটেকনিকে আবার ইংরেজি ডিপার্টমেন্ট!!!
শেষ পর্যন্ত রিকশা থেকে নেমে শুধু বলেছিলাম,মামা এখন থেকে কেও জিজ্ঞেস করলে বলবা কম্পিউটার সাইন্সে পড়ি।



তাইবলে সবাই কিন্তু এমন না, এত মামাদের ভিড়ে হাতেগোনা কিছু মামা এমন থাকবেই। আর আরও ভালো করে ভাবলে দেখা যাবে এরাও অনেক ভালো কারন কিছু টাকা বেশী পাওয়ার আশায় একটু মিথ্যা বলে মানুষের সিম্পেথি পাওয়ার চেষ্টা মাত্র, আপনার ইচ্ছে হলে দিবেন আর না হলে দিবেন না।  কিন্তু চোর বাটপার রা?? 

তবে একটা বিষয় দেখেছি, যত রিকশাওয়ালা মামার সাথেই গল্প করেছি কেউ বিরক্ত হয়নি বরং খুশিই হয়।


যাইহোক বেশ কিছুদিন আগে খুব কাছের একটি বন্ধুর জন্মদিন সেলিব্রেশন করার জন্য তার বাসার দিকে যাচ্ছিলাম ৭-৮ জন মিলে, যাওয়ার সময় যেটা দেখলাম ধানমন্ডির আবাহনী মাঠের উত্তর পাশের ফুটপাত, একজন ৪৫-৫৫ বছরের চাচা একটা ভ্যানের উপর কিছু প্লেট আর একটা ভাতের পাতিল নিয়ে বসে আছে আর রাস্তার উপর বেশ কিছু খালি রিকশা দাঁড়ানো, কাছে যেতেই দেখলাম সবগুলা প্লেটে কিছু পরিমান খিচুরি ভাত সাজানো আর পাশের একটা প্লেটে শুকনা মরিচের সাথে পিয়াজ আর তেল দিয়ে ভর্তা, আর একটা ছোট্ট পাতিলে ডিম রান্না করা। 

কৌতূহল নিয়েই জিগ্যেস করলাম চাচা কত করে প্লেট? 
চাচার সরল উত্তর মরিচ ভর্তা নিলে ১৫টাকা আর ডিম নিলে ২৫টাকা। তো দাম শোনার পর একটু দাঁড়িয়ে দেখতেছিলাম নিম্নমধ্যবিত্তের উদাহরণ
আশ্চর্যের বিষয় সেখানে প্রায় ১০-১২ জন রিকশাওয়ালা  একসাথে খাবার নিল এবং সবাই ডিম ছাড়া মানে ১৫টাকার খিচুরির সাথে মরিচ ভর্তা!!

খাওয়ারের পরিবেশটা এমন যে কোন দেওয়ালের সীমানা নেই,চারিদিকে খোলা,রাস্তা দিয়ে হরদম গাড়ি চলাচল, এমনকি বসার মতো একটা টুল ও নেই, যার যার রিকশায় সে সে বসে খাচ্ছে।


আমার জানামতে ঢাকা শহরের একজন রিকশাওয়ালা সারাদিন রিকশা চালালে সর্বোচ্চ ৫০০-৭০০ টাকা ইনকাম করতে পারে, আর এর মধ্যে তার রিকশার জমা টাকা, তার থাকা, খাওয়া এবং একটা মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসের ও দরকার হয় তাতে সব মিলে কি এই টাকাটা যথেষ্ট?  
আবার তাদের যে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি তাতে করে ভর দুপুরে এই মরিচ ভর্তা দিয়ে ১ প্লেট খিচুরি খেয়ে কি রিকশা চালানো সম্ভব?

তাও মনে হয় সম্ভব ১টা ডিম দিয়ে দুই প্লেট ভাত খাওয়া কিন্তু দিন শেষে তাদেরও একটা পরিবার আছে যারা সবসময় সেই অতি সাধারণ রিকশা চালকের রোজগারের দিকে তাকিয়ে থাকে আর হয়তোবা এই ভাবনাতেই শুকনো মরীচ ভর্তা দিয়ে ভাত খেয়েও হাসা যায়!!!


আচ্ছা একবার ভাবুনতো আমার আপনার ১৫টাকা দিয়ে কি ১বেলা খাওয়া হবে?
আপনি কি পারবেন এই মরিচ ভর্তা দিয়ে খেয়ে সারাদিন এমনি থাকতে? রিক্সা নাহয় নাই চালালেন।  

তাহলে কী বলবো?? তারা কী মানুষ না?? হ্যাঁ তারাও মানুষ কিন্তু গরিব মানুষযাদের স্বপ্ন হয় রঙ বিহীন ফ্যাকাসে! যারা যাত্রীর থেকে ২-৫ টাকা বেশী নিয়ে বাড়ি গাড়ি করে না বা ভালো কোন রেস্টুরেন্টে গিয়ে চেক-ইন  ও দেয় না, তারা হল সেইসব মানুষ যারা নিজেরা রংচটা স্বপ্ন দেখে ঠিকই কিন্তু নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে আরেক জনের স্বপ্ন রঙ্গিন করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে।

ভাবছেন তারা আবার কিভাবে আরেকজনের স্বপ্ন রঙিন করে? কখনো কি দেখেছেন কোন রিকশাওয়ালা বলেছে তার ছেলেকে সে রিকশা চালক বানাবে? সেই রিকশাচালক ও স্বপ্ন দেখে কিন্তু নিজেকে নিয়ে না তার সন্তান্দের নিয়ে।

 আর অনেক বেশী হাড়ভাঙ্গা খাটুনি করেও তাদের স্বপ্ন হয় অনেক ছোট।


          ভালো থাকুক মামা গুলা......ভালো থাকুক তাদের পরিবার 

No comments:

Post a Comment

Thanks for your comment